কক্সবাজারে হাত বাড়ালেই মিলছে অত্যাধুনিক ছুরি-চাকু

মুহিবুল্লাহ মুহিব •

পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহরে হাত বাড়ালেই মিলছে শতাধিক রকমের অত্যাধুনিক ছুরি-চাকু। বিক্রিতে আইনি বাঁধা না থাকায় এসব ‘মরণাস্ত্র’ সহজেই পাওয়া যাচ্ছে, যা ব্যবহার হচ্ছে ছিনতাই বা হত্যার মতো অপরাধ সংঘটনে।

এছাড়াও খুব সহজে বহনযোগ্য এসব ‘মরণাস্ত্র’ চলে যাচ্ছে অপরাধীদের হাতে। স¤প্রতি আলোচিত হত্যাকান্ডের প্রায় সবগুলোতেই হাতিয়ার হিসেবে ছুরি বা ছুরি সদৃশ্য ধারালো অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণও পাওয়া গেছে। চার বছর আগে এ ধরণের ছুরি দিয়েই ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্য পারভেজকে ছুরিকাঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল ছিনতাইকারীরা।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, দামে কম এবং আকারে ছোট হওয়ায় কাজ শেষে ছিনতাইকারীরা এসব অস্ত্র ফেলে দিয়ে আলামত নষ্ট করে ফেলে। ফলে সন্দেহ হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উপায় থাকে না।

আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তথ্যমতে, চলতি মাসের গেল ১৫ দিনে ছিনতাই, ডাকাতি প্রস্তুতিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত দেড় শতাধিক আসামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ। এসব আসামী থেকে অর্ধ-শতাধিক ছুরি-চাকু উদ্ধার করা হয়। যেসব ছুরি হত্যাকান্ডসহ বহু অপরাধে ব্যবহার হয়েছে নিয়মিত।

তার মধ্যে, কক্সবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা অভিযান চালিয়ে গত ১২ মার্চ গভীররাতে চার কিশোর ছিনতাইকারীকে আটক করেছিল। ওই সময় তাদের তল্লাশি করে দুইটি টিপ ছুরি উদ্ধার করে। ৩১ জানুয়ারি রাতে শহরের টেকপাড়া থেকে বহু মামলার আসামী দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছ থেকেও দু’টি টিপ ছুরি উদ্ধার করা হয়।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে সৈকত এলাকা থেকে আটক দুই ছিনতাইকারীর কাছ থেকে দুটি ছুরি উদ্ধার করেছে র‌্যাব-১৫ এর সদস্যরা। গত ৯ মার্চ কলাতলী এলাকায় র‌্যাব অভিযান চালিয়ে ছিনতাইকারী চক্রের ৫ সদস্যের কাছ থেকে তিনটি ছুরি উদ্ধার করে। ১৩ মার্চ রাতে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে ৬জন ছিনতাইকারীকে আটক করে র‌্যাব।

এসময় উদ্ধার করা হয়েছে ২টি ড্যাগার, একটি ছুরি ও একটি খুর। ১৫ মার্চ একই জায়গা থেকে ৪ জন ছিনতাইকারীকে আটকের পর তিনটি ছুরি উদ্ধার করে র‌্যাব। সৈকত এলাকা থেকে ১৭ মার্চ কিশোর গ্যাংয়ের ৫ সদস্যকে আটক করেছিল র‌্যাব। ওই সময় তাদের কাছ থেকে ৪টি ড্যাগার ও একটি চাপাতি উদ্ধার করে। ২১ মার্চ ড্যাগার, ছুরি ও খুরসহ ৪ ছিনতাইকারীকে লাবণী বীচ পয়েন্ট থেকে আটক করে র‌্যাব।

এদিকে গত মঙ্গলবার রাতে কক্সবাজার বাস টার্মিনাল এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে খুন হন ব্যবসায়ী আবুল কালাম। গত রোববার ঈদগাঁওতে দুর্বৃৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন দোকানদার তারেক। ২৮ মার্চ কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে নিহত হন কলেজ ছাত্র রিদুয়ান। ৫ এপ্রিল পিএমখালীতে ছুরিকাঘাতে খুন হয় জাহাঙ্গীর নামে এক যুবক। গত ৮ এপ্রিল দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে কক্সবাজার ঝাউতলা এলাকার রিগ্যান। শুধু তাই নয়, সাধারণ পর্যায়ে পর্যন্ত এসব ছুরি দিয়ে লোকজন যেনতেনভাবে হুমকি প্রর্দশন করতে দেখা যাচ্ছে।

আর কক্সবাজার শহরে সহজে মিলছে এসব অত্যাধুনিক ছুরি। ছুরি-চাকু অবাধ বিকিকিনি ও বহনের বিষয়টি নজরদারিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও গা ছাড়া।

শহরের বার্মিজ মার্কেট, কৃষি অফিস রোড, সৈকতের লাবনী পয়েন্ট, সুগন্ধা পয়েন্ট, কলাতলী পয়েন্ট, হোটেল-মোটেল জোন ও হিমছড়িসহ পুরো কক্সবাজার জুড়েই বিভিন্ন দোকানে শোপিচ এর নামে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে এসব ছুরি। থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন ব্যান্ডের এসব ছুরি সহজেই কিনে নিয়ে পেশাদার ছিনতাইকারী ও বখাটেরা জড়িয়ে পড়ছে খুন, ছিনতাই ও অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধে।

জানা গেছে, দেশি-বিদেশি ছুরি শোপিচ হিসেবে বিক্রির জন্য দোকানে রাখছে ব্যবসায়ীরা। থাইল্যান্ডের এসব ছুরি ৫ ইঞ্চি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৩/১৪ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা। এসবের দাম ৫৫০ থেকে ৮০০/৯০০ টাকা পর্যন্ত। দেখতে অনেকগুলো ছুরি টিপু সুলতানের তলোয়ারের মতো। আবার অনেকগুলো সুইচের ছুরি। এসব ছুরি পেশাদার ছিনতাইকারী ও বখাটেরা বেশি কিনছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় কক্সবাজার প্রেসক্লাব ও কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু তাহের বলেন, কক্সবাজার জেলার ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় স¤প্রতি আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। এখানো রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে শ্রবাজার দখল, যান বাহনের চালক হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য কর্মে নিয়োজিত হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে স্থানীয়রা বেকার হচ্ছে দিন দিন। একই সঙ্গে স্থানীয়দের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র ক্ষোভের।

তিনি আরও জানান, সুযোগ পেলেই অপরাধীরা বিভিন্নভাবে চুরি-ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে। আর এতে বেশি ব্যবহার হচ্ছে নানা রকমের ছুরি-চাকু। আমি মনে করি, আইন-শৃঙ্খলার স্বার্থেই ছোট ছুরি-চাকু আমদানি ও বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

এ বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন- ইতিমধ্যে আমরা সিন্ধান্ত গ্রহণ করেছি, যেসব দোকানে ছুরি ও চাকু বিক্রি হয় তাদের নিরুৎসাহিত করতে। এবিষয়ে ব্যবসায়ীদের সাথেও কথা বলা হবে।

ছুরি উদ্ধারের বিষয়ে তিনি বলেন- কয়েকটি দোকান সৌখিনভাবে এসব ছুরি বিক্রি করা হয়। হয়ত অনেকে এসব দোকান থেকে কিনে অপরাধে জড়িত পড়ে। এমন অনেক ছুরি ইতিমধ্যে পুলিশ আটক ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে উদ্ধারও করেছে। আমরা শীঘ্রই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবো।